logo

শিরোনাম

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে: স্বপ্নের সড়ক নাকি মৃত্যুফাঁদ?

নিউজ সেভেন্টি ওয়ান ডট টিভি ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ২৫ আগস্ট, ২০২৫ | সময়ঃ ১২:০০
photo
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে: স্বপ্নের সড়ক নাকি মৃত্যুফাঁদ?

জিতু রায়: দেশের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে পরিচিত। এটি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করেছে এবং পরিবহণে সময় ও খরচ কমিয়েছে। তবে সড়কটি ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের সড়ক হিসেবে পরিচিত।  

শুধু ২১ আগস্টে একদিনে এক্সপ্রেসওয়েতে দুইটি দুর্ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারিয়েছেন। এ বছর ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এই সড়কে ১৪টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছেন। গত তিন বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে তেরো শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে ১৮৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং সহস্রাধিক মানুষ আহত হয়ে স্থায়ীভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন।


ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এখন যেন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনায় দেখা গেছে, ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার রাতেই সিরাজদিখানে প্রাইভেটকারের সঙ্গে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ গেল তিন তরুণের, আহত হলো আরও একজন। এর আগে সকালেই উল্টে যাওয়া এক প্রাইভেটকার কেড়ে নেয় আরও তিন প্রাণ। একদিনে ছয়টি মৃত্যু যেন সতর্ক বার্তা।

প্রশ্ন জাগে—কেন বারবার ঘটছে এমন দুর্ঘটনা? প্রথমত, সড়কটিতে নকশাগত কিছু ত্রুটি রয়েছে। দীর্ঘ সোজা রাস্তা হওয়ায় চালকেরা গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না। কোথাও কোথাও সার্ভিস লেনের সঙ্গে মূল সড়কের অস্পষ্ট বিভাজন হঠাৎ দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। 

দ্বিতীয়ত, মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে ট্রাফিক আইন অমান্য, হেলমেট ব্যবহার না করা এবং একাধিক আরোহী বহনের প্রবণতা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনাতেই দেখা গেছে, নম্বরবিহীন মোটরসাইকেলে চারজন যাত্রী ছিলেন।


তৃতীয়ত, সচেতনতার ঘাটতি। যাত্রী ও চালক উভয়েই মনে করেন, এক্সপ্রেসওয়ে মানেই ‘গতি’। অথচ গতি যত বাড়ে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকিও তত বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার এক-তৃতীয়াংশ ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে। শীতকালে ঘন কুয়াশায় দৃশ্যমানতা কমে গেলে এই ঝুঁকি আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।


চতুর্থত যথাযথ সিগন্যাল ও আলোকায়নের অভাবও ঝুঁকি বাড়ায়।ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টি, শীতকালে দৃশ্যমানতা কমিয়ে দেয়, যা দুর্ঘটনা প্রবণতা আরও বৃদ্ধি করে। তবে গ্রীষ্মকালেও বৃষ্টি ও রোদের প্রতিফলনের কারণে দূরত্ব ও যানবাহন বোঝার ক্ষমতা কমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে।গ্রীষ্মকালে এ দুর্ঘটনা যেমন ঘটছে, শীতকালে ঘন কুয়াশায় এ পথ হয়ে ওঠে আরও ভয়ঙ্কর। দৃশ্যমানতা কমে গিয়ে তখন দুর্ঘটনার হার দ্বিগুণ হয়ে যায়। একমুখী সড়কে ধীরগতির গাড়ি বা থেমে থাকা যানবাহনে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া, ওভারটেকিং ও ট্রাফিক আইন অমান্য করাও এক্সপ্রেসওয়ে দুর্ঘটনার সাধারণ কারণ।গত বছর ঘন কুয়াশায় শীতকালে আলাদা আলাদা স্থানে এক রাতেই ৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। 


দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এখন প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রথমত, সড়ক সংস্কার জরুরি। ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করা, স্পিড বাম্প ও পর্যাপ্ত সাইনবোর্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। শীতকালে ঘন কুয়াশার মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল সীমিত করা, সড়ক আলোকায়ন ও হেডলাইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে ঝুঁকি অনেকটা হ্রাস পাবে।দ্বিতীয়ত, চালকের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ও নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত ট্রাফিক আইন অনুসরণ ও অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ  করা।তৃতীয়ত, গাড়ির নিয়মিত মেইনটেন্যান্স, বিশেষ করে ব্রেক ও টায়ারের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। চতুর্থত, হাইওয়ে পুলিশকে আরও আধুনিক প্রযুক্তি—স্পিডগান, সিসিটিভি ও ড্রোন মনিটরিং—ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। দুর্ঘটনা ক্ষেত্রে দ্রুত উদ্ধার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার।স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে, যেন তারা অবৈধ পারাপার ও মোটরসাইকেলে অতিরিক্ত গতি ও যাত্রী এড়িয়ে চলেন।

 

ঢাকা–মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের গতির প্রতীক, কিন্তু নিরাপত্তা–শাসন ও নকশা–শৃঙ্খলা না বাড়ালে এটি আরও প্রাণ কাড়বে। গ্রীষ্মে অতিরিক্ত গতি, শীতে কুয়াশা—দুই মৌসুমে দুই রকম ঝুঁকি; নীতিরও তাই ‘মৌসুমি মোড’ থাকা চাই। এখন সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—গতি কমানো, শাসন কড়া করা, ব্ল্যাক স্পট সারানো, আর শীতে ফগ–প্রটোকল চালু করা। নইলে প্রতিটি হেডলাইন হবে আরেকটি বাড়ির শোকসংবাদ—আরেকটি প্রশ্ন: আমরা কি নিরাপত্তার চেয়ে গতিকেই বড় রাখব?
এক্সপ্রেসওয়ের প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু পরিসংখ্যান নয়, পরিবার হারানোর একেকটি বেদনাময় গল্প। প্রশ্ন জাগে—আর কত প্রাণ ঝরার পর আমরা নিরাপদ মহাসড়কের পথে হাঁটব? এখন সময় এসেছে নিয়ম, মনোভাব, এবং স্থাপত্য মিলিয়ে এক যুগান্তকারী সড়ক নিরাপত্তা সংস্কার আনার। না হলে, এক্সপ্রেসওয়ের নাম তখন স্মরণ করবে প্রতিটি মৃত্যু, অপরিকল্পিত নির্মাণ ও সচেতনতা অভাবের ফলে! স্বপ্নের এক্সপ্রেসওয়েকে যেন আর কবরগাহে পরিণত হতে না হয়—এর জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। জীবন বাঁচানোই উন্নয়নের আসল সাফল্য।

  • নিউজ ভিউ 3168