logo

শিরোনাম

মুন্সীগঞ্জে সাবেক সংসদ সদস্যসহ ১৪২ জনের নামে আরো একটি মামলা

নিউজ সেভেন্টি ওয়ান ডট টিভি ডেস্ক
প্রতিবেদন প্রকাশ: ০১ নভেম্বর, ২০২৪ | সময়ঃ ১২:০০
photo
মুন্সীগঞ্জে সাবেক সংসদ সদস্যসহ ১৪২ জনের নামে আরো একটি মামলা

নিজস্ব প্রতিনিধি – মুন্সীগঞ্জের শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বিএনপির এক কর্মী আহত হওয়ার ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ-১ ও মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক দুই সংসদ সদস্যসহ ১৪২ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আরো একটি মামলা হয়েছে।   । ওই মামলায় ১৪২ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও   আরও ১০০ থেকে ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে।
 শুক্রবার রাত ৮ টার দিকে  মামলার বিষয়ে নিশ্চিত করে মুন্সীগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ ( ওসি ) খলিলুর রহমান বলেন, মামলাটি আজ শুক্রবার ( ১ নভেম্বর) এফআইআর করা হয়েছে। তবে এই মামলায় এখনো কোন আসামী গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার পর আহত মঞ্জিল মোল্লা (৫৩) বাদী হয়ে মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন।
বাদী মঞ্জিল মোল্লা মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার ইব্রাহীম মোল্লার ছেলে। তিনি পেশায় দিনমজুর ও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হতাহতের ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় তিনটি হত্যা, দুটি হত্যাচেষ্টাসহ মোট পাঁচটি মামলা হলো।
নতুন এই মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য আনিসুর রহমান ওরফে রিয়াদ, মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান, মুন্সীগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মতিন, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান ভূঁইয়া, সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান, পঞ্চসার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, রামপাল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাচ্চু শেখ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. সুরুজ, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত হোসেন, সোনারং টঙ্গিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন লিটন মাঝি , টঙ্গিবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার কাজি আব্দুল ওয়াহিদ , টঙ্গিবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক  ভাইস চেয়ারম্যান নাহিদ খান , গজারিয়ায় উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম,  জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ আহমেদ পাভেল  প্রমুখ।
৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জের সুপার মার্কেটে এলাকায় আন্দোলনে গিয়ে পিঠ, হাত ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন মামলার বাদি মঞ্জিল মোল্লা।  ঝাঝড়া হয়ে গেছে তার খাদ্যনালী,  বর্তমানে তার দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে। একদিকে ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে হিমশিম, অন্যদিকে পরবর্তী চিকিৎসা ব্যায় নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। দুই দফা অপারেশনে প্রাণ বাঁচলেও অর্থ সংকটে বন্ধ পরবর্তী চিকিৎসা। পূর্ণাঙ্গ ব্যয়বহন ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও স্থানীয়রা।
জানাগেছে, গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেটে এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। খবর পেয়ে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় মুন্সীগঞ্জ ৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব ও তার অনুসারী আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশও কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। সকালের দিকে শিক্ষার্থীরা শহরের সুপারমার্কেট সংলগ্ন পাতাল মার্কেটের সামনে এলে তাদের উপর চড়াও হন ফয়সাল বিপ্লব অনুসারীরা। এ সময় লাঠিপেটা ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের কৃষি ব্যাংক এলাকা ও উত্তর ইসলামপুর থেকে শত শত আন্দোলনকারী বেড়িয়ে পড়েন। তারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে শহরের মূল কেন্দ্র অঙ্কুরিত যুদ্ধ ১৯৭১ ভাস্কর্যের সামনে পর্যন্ত এলে চরকেওয়ার, আধারা, মোল্লাকান্দি, শিলই থেকে আসা শত শত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিস্তল-রাইফেল, শর্টগান, হাতে বানানো অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
সেসময় আহত মঞ্জিলের ডান হাতে গুলি লাগলে তার হাতে থাকা ইটের সুড়কি পড়ে গিয়ে হাড় ফেটে বের হয়ে যায় সেটি। দ্বিতীয় গুলি লাগে পিঠে। এরপর তৃতীয় দফায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে অবস্থা গুরুতর হলে মাটিতে লুটে পড়ে যান তিনি। ওইদিন গুলিতে মারা যান মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুরের সজল মোল্লা (৩১), রিয়াজুল ফরাজী (৩৮) ও নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল (২২)।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন মঞ্জিলকে উদ্ধার করে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পিঠের গুলি সহসা বের হলেও খাদ্যনালীতে আটকে যাওয়া গুলি নিয়ে বেগ পেতে হয় চিকিৎসকদের। পরবর্তীতে বিডিআর হাসপাতালে খাদ্যনালীর ৪টি নাড়ি কেটে গুলি বের করলেও জায়গাটি শুকানোর জন্য স্বাভাবিক রাস্তা দিয়ে পায়খানা বন্ধ রেখে পেটের সাইড দিয়ে কেটে ব্যাগ বসিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। দেড় মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরেছেন উত্তর ইসলামপুরের মঞ্জিল মোল্লা। পরবর্তী অপারেশন হলে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা।
তবে, অর্থ সংকটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বজনরা। অন্যদিকে, ১০ সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকায় উভয় সংকটে রয়েছে পরিবারটি।
আহত মঞ্জিল মোল্লা বলেন,‘আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার শরীরে ৩টি গুলি লাগে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনমতে আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আমার উপর গুলি ছুড়েছে আমি তাদের বিচার চাই।’
আহত মঞ্জিল মোল্লার বড় মেয়ে রুপা আক্তার বলেন,‘আমার বাবার পরবর্তী অপারেশনের জন্য ২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই ব্যায় মিটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকারিভাবে বহন করা হবে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আমার এক ভাই বিবাহিত, সেও বেকার। আমাদের দাদা-দাদীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। তার আয়ে সংসার চলে। এভাবে কতদিন চলতে পারবো জানিনা। সরকারের প্রতি আহবান আমাদের পরিবারটির দিকে তারা যেন নজর দেয়।’

প্রতিবেশী রবিউল মাষ্টার বলেন, ‘উনার একটা ছেলে আছে, অনেক কষ্ট করে বাড়ির পেছনের জমি বিক্রি করে তাকে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ওই ছেলের কাজ নেই, বেকার। সরকারের কাছে আমাদের আশা- তারা যদি ছেলেটাকে একটা কাজ দেয় তাহলে সংসারটা বেঁচে যাবে। নাহলে কয়দিন পরে তাদের পথে বসতে হবে।’

স্থানীয় ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘উনার দুইটা সহযোগিতা দরকার। এমন একটা ব্যবস্থা হোক যাতে উনার পরিবারটা চলতে পারে আরেকটা বিষয় হচ্ছে সরকার এমন দায়িত্ব নিক যেন যে পর্যন্ত উনি পুরোপুরি সুস্থ না হয় সে পর্যন্ত সকল ব্যায়ভার বহন করে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আহত মঞ্জিলের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করতে আমাদের উপর নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে মঞ্জিলকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আশা করছি- তিনি সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাবেন। এছাড়া তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সিএমএইচে যোগাযোগ করলে পরবর্তী চিকিৎসাটি বিনামুল্যে সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা করছি।’
মামলার এজাহার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তর ইসলামপুরের বিএনপির নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। ওইদিন সকাল পৌনে ১০টার দিকে ছাত্র-জনতা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় জড়ো হলে মিরকাদিম পৌরসভার আওয়ামী সভাপতি  সাবেক মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিন এর নির্দেশে  শিক্ষার্থীদের উপর হামলার জন্য অস্ত্র-ককটেল নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। ২-৩ হাজার দলীয় নেতাকর্মী ও অনুসারীরা  পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা  শিক্ষার্থীদের পেটাতে শুরু করেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাগরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালান। অন্যদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিতে উত্তর ইসলামপুরের রিয়াজুল ফরাজী, সজল মোল্লা ও নুর মোহাম্মদ মারা যান। এতে দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন এই মামলার বাদি মঞ্জিল মোল্লার পেটে, পিঠে ও হাতে তিনটি গুলি লাগে। ঘটনার পর থেকে আড়াই মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন মঞ্জিল। এখনো তাঁর চিকিৎসা চলছে।
মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার শামসুল আলম সরকার বলেন, ‘তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

  • নিউজ ভিউ 2205